চকরিয়ায় চতুর্থ ধাপে ৮ ইউপি নিবার্চন

নৌকার মনোনয়ন পেতে বিতর্কিত নেতারাদেরও দৌড়ঝাপ !

এ কে এম ইকবাল ফারুক,চকরিয়া :

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসীল অনুযায়ী চতুর্থ ধাপে আগামী ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে চকরিয়া উপজেলার অবশিষ্ট ৮ ইউনিয়ন পরিষদ নিবার্চন।

এ নিবার্চনে ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের একাধিক নেতা। তাদের মধ্যে গত নিবার্চনের বিদ্রোহী ও বির্তকিত প্রার্থীরাও রয়েছেন।

উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় ধাপে আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চকরিয়া উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের নিবার্চন।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষনা অনুযায়ী চতুর্থ ধাপে আগামী ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে উপজেলার অবশিষ্ট ৮ ইউনিয়ন বরইতলী, হারবাং, বমুবিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, চিরিংগা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়ন পরিষদের নিবার্চন।

জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী টানা চারবার চেয়ারম্যান নিবার্চিত হয়েছেন উপজেলার ফঁাসিয়াখালী ইউনিয়নে। তিনি এবারও চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে এই ইউনিয়নে তিনি বারবার প্রাথর্ী হওয়ায় দলে নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না বলে অভিযোগ তৃণমুল নেতাকমর্ীদের।

এবার ফঁাসিয়াখালী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা যুবলীগের সিনিয়র সদস্য হেলাল উদ্দিন হেলালী।

উপজেলার চিরিংগা ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের টিকেট পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শাসকদলের দুই প্রাথর্ী। তাদের মধ্যে একজন চকরিয়া উপজেলা কৃষকলীগের সভাপতি ও তিনবারের নিবার্চিত বর্তমান চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি গত নির্বাচনের বিদ্রোহী প্রার্থী জামাল হোসেন চৌধুরী। দীর্ঘসময় ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বর্তমান চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন ইউনিয়নের জনপদে সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা পৌঁছে দিয়ে চলছেন।

তাঁর বিরুদ্ধে বড়ধরণের কোন অভিযোগ না থাকলেও মনোনয়ন প্রত্যাশী অপর প্রাথর্ী জামাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে গেল নিবার্চনে দলীয় সিদ্বান্ত উপেক্ষা করে বিদ্রোহী প্রাথর্ী হয়ে ভোটযুদ্ধে থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি সম্প্রতিক সময়ে বেশকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বেশ সমালোচিতও হয়েছেন।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকমর্ীদের দাবি, সম্প্রতি সময়ে উপজেলার চিংড়িজোনের চিরিংগা মৌজায় নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুছের মালিকানাধীন গ্রামীণ ব্যাংকের সাড়ে তিনশত একরের একটি চিংড়িঘের দখলের ঘটনা ঘটেছে।

এ ঘটনায় আওয়ামীলীগ সভাপতি জামাল চৌধুরী ও তাঁর লোকজন জড়িত বলে গ্রামীণ বাংকের কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলেছেন। ওই ঘটনায় চকরিয়া থানায় ৪৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছে। এছাড়াও প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের তৈরীর অভিযোগে উপকুলীয় বনবিভাগ চকরিয়া আদালতে অন্তত ৯টি মামলা করেছে। এসব মামলায় জামাল চৌধুরী ছাড়াও একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করেছেন বনবিভাগ।

ওইসময় উপকুলীয় বনবিভাগ থেকে অভিযোগ করা হয়, সৃজিত প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়িঘের তৈরীর ঘটনায় জড়িত সেই চিরিংগা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জামাল হোছাইন চৌধুরী। তখনকার সময় জামাল চৌধুরীসহ তাঁর সহযোগিদের এই ধরণের অপতৎপরতার বিশদ বিবরণ দিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে উপকুলীয় বনবিভাগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সেখানে অভিযান চালিয়ে প্যারাবন নিধনে ব্যবহৃত স্কেভেটর গাড়িও জব্দ করেন।

২০০৩ সালে বমুবিলছড়ি ইউনিয়নকে বিভক্তি করে সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই থেকে গত তিনটি নিবার্চনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের প্রাথর্ী চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আজিমুল হক বিপুল ভোটে নিবার্চিত হয়ে আসছেন।

একসময় ইউনিয়নটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বর্তমান চেয়ারম্যান আজিমুল হক সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা পৌঁছে দিয়ে এলাকার গণমানুষের কাছে যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তেমনি বিএনপির সেই দুর্গ ভেঙ্গে সুরাজপুর-মানিকপুরকে নৌকার ঘাঁিট হিসেবে তৈরী করেছেন। এর প্রমাণ মিলেছে, ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়াও গত তিনটি সংসদ নিবার্চন এবং দুইটি উপজেলা পরিষদ নিবার্চনে এই ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে নৌকার নিরস্কুশ বিজয়ের মধ্যদিয়ে। এবারের নির্বাচনেও বর্তমান চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী। স্থানীয় জনসাধারণ ও দলীয় নেতাকমর্ীদের মাঝে তিনি একজন ক্লিন ইমেজের প্রাথর্ী হিসেবে বেশ সুনাম রয়েছে।

তবে এ ইউনিয়নে এবারও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছেন চকরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি আওয়ামীলীগ নেতা রুস্তম শাহরিয়ার। গত নিবার্চনে তিনি দলীয় সিদ্বান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রাথর্ী হয়ে ভোট যুদ্ধে ছিলেন। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও দেশে ফিরে তিনি এখন এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন।

২০১৬ সালের নিবার্চনে হারবাং ইউনিয়নে নৌকার টিকেটে চেয়ারম্যান নিবার্চিত হয়েছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মিরানুল ইসলাম মিরান। তার শাসনামলে নানা ধরণের অপকর্মে জড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এমন অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকমর্ীদের।

তাদের দাবি, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে গরু চুরির অপবাধে ইউনিয়ন পরিষদের আটকে রেখে মা-মেয়েকে রশিতে বেঁেধ নিযার্তনের ঘটনায় শুধু চকরিয়া কক্সবাজার নয়, সারাদেশে বেশ আলোচিত সমালোচিত হন চেয়ারম্যান মিরান। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। হারবাং ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতাকমর্ীদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মিরানের বর্বরোচিত এই ঘটনায় আওয়ামীলীগের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে।

এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে হারবাং মাজারের খাদেমকে নিযার্তন, তাঁর পরিবারকে হয়রানি এবং বিচারপ্রাথর্ী বৃদ্ধাকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা।

হারবাং মা-মেয়েকে নির্যাতনের বিষয়টি সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নিন্দার ঝড় ও ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলামকে গ্রেফতারের দাবী উঠে। পাশাপাশি হারবাং ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতির পদ থেকেও বহিস্কারের দাবী জোরালো হতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও মুলধারার গণমাধ্যমে বির্তকিত চেয়ারম্যান মিরানের নানা অপকর্ম, ঘুষ দূর্নীতি বিচার বাণিজ্য, সরকারি ও বনবিভাগের জায়গা দখলের মতো ঘটনা নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়।

এছাড়া পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে, ২১ আগষ্ট গরুচুরির মিথ্যে অপবাদ দিয়ে কিভাবে মা-তিন ছেলে মেয়েকে  মারধর করে তা উঠে এসেছে। ওইসময় তাদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। এছাড়া তিনি পরিষদের গ্রাম আদালতে বিচারকার্য চলাকালে বিচারপ্রাথর্ীদের গালি-গালাজ এমনকি হাত তুলতেও দ্বিধা করেনা বলে অভিযোগ ভূক্তভোগীদের।

এসবের পরও তাঁর বিরুদ্ধে বনবিভাগের জায়গা অবৈধভাবে দখলের অভিযোগও আছে বলে দাবি করেন আওয়ামীলীগ নেতাকমর্ীরা। নিজের এসব অপকর্মের জন্য আলোচিত সমালোচিত হলেও এবারের নিবার্চনে চেয়ারম্যান পদে আবারও নৌকার টিকেট পেতে চান মিরানুল ইসলাম মিরান।

এছাড়া হারবাং ইউনিয়নে এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন ক্লিন ইমেজের অধিকারী সাবেক ছাত্রনেতা ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেরাজ উদ্দিন মিরাজ। তিনি ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামীলীগের সর্বমহলের যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। পাশাপশি এলাকায় সাধারণ জনগণ ও নেতাকমর্ীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে তাঁর প্রাথর্ীতা হবার প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়াও হারবাং ইউনিয়নে এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামীলীগ নেতা পরিমল বড়–য়া। তিনি এলাকার সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছেন। এ ইউনিয়নে প্রায় ৬ হাজার হিন্দু বৌদ্ধ ও রাখাইন সম্প্রদায়ের ভোটার রয়েছে। নৌকার টিকেটে হাতে পেলে রিজার্ভ এসব ভোট ব্যাংকে পরিমল বড়–য়াকে নিবার্চনী বৈতরণী পার হতে বেগ পেতে হবেনা এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন দলীয় নেতাকমর্ী এবং অভিজ্ঞ মহল।

চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠিত বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ নিবার্চনে চেয়ারম্যান পদে প্রাথর্ী হচ্ছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এটিএম জিয়া উদ্দিন চৌধুরী জিয়া। তিনি এবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন এটি শতভাগ নিশ্চিত। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকমর্ীদের দাবি, উপজেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে থাকায় গেলবারের নিবার্চনে নৌকার প্রাথর্ী জিয়াউদ্দিন চৌধুরীকে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়েছে।

ডুলাহাজারা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন চারজন প্রার্থী।  তাঁরা হলেন চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মোক্তার আহমদ চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা শাহনেওয়াজ তালুকদার, আওয়ামীলীগ নেতা কলিম উল্লাহ কলি ও বির্তকিত যুবলীগ নেতা হাসানুল ইসলাম আদর। তাদের মধ্যে কলিম উল্লাহ কলি এলাকার উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাকে পুঁজি করেই তিনি দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্ঠা করছেন।

নির্বাচনের তারিখ ঘোষনার আগে থেকেই খুটাখালী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জয়নাল আবেদীন, সাধারণ সম্পাদক  বাহাদুর আলম ও সিনিয়র সহ-সভাপতি বেলাল আজাদ। গত নিবার্চনে নৌকা পেয়েছিলেন বাহাদুর আলম। ওইসময় তার বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন জয়নাল আবেদীন।

একইভাবে বমুবিলছড়ি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন চাচ্ছেন প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা মনজুর কাদের, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সস্পাদক নুরুল ইসলাম ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি কফিল উদ্দিন। গতবারের নির্বাচনে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন কামাল উদ্দিন। তবে তিনি অসুস্থতার কারণে এবার মনোয়ন চাচ্ছেন না